পরবর্তী সংবাদ একটু পরেই

195.00

লিখলেন – অভিষেক গুহ রায়

পরবর্তীসংবাদএকটু পরেই

পলান্ন প্রকাশনী

Category:

Description

বাংলা সাহিত্যে সামাজিক লেখার একপ্রকার গতানুগতিকতা আছে। সেখানে ঘটনা নির্বিশেষে পাত্র, পাত্রী, পারিপার্শ্বিকতাকে মাথায় রেখে একরৈখিক ছন্দে ঘটনাপ্রবাহ বয়ে চলে। সেসব লেখায় স্থানবিশেষে গভীরতা বা লঘুতার ওঠানামা অবশ্যই থাকে, যা সেই উপন্যাসটিকে গুরুত্ব, গতিময়তা প্রদান করে। কিন্তু গানের মতো লেখারও যদি সুর, তাল কিংবা লয় নির্ধারণের উপায় থাকত তাহলে দেখা যেত তা একমাত্রিক; অর্থাৎ কিনা একই পরিবেশের আবর্তে ঘূর্ণায়মান। ঠিক ওস্তাদের গানের নেপথ্যে সেতার যেভাবে একটাই সুরে সঙ্গত দান করার জন্য ব্যবহার করা হয়। শুনতে মিষ্ট, কিন্তু একটাই সুর।

লেখক Arghya Dutta এই অলিখিত প্রথাটাকেই নিপুণভাবে ভেঙেছেন। ‘পরবর্তী সংবাদ একটু পরেই’ নামের সার্থকতা বজায় রেখে শুরু থেকেই পাঠকের অজান্তেই তাকে আলাদা আলাদা প্রেক্ষাপটে বিবিধ সংবাদ পরিবেশন করতে থাকে। কখনো তা কলকাতার জানা অজানা ঘাটের ইতিহাসকে ছুঁয়ে যায়, কখনো তা অন্যতম মূল চরিত্র জার্নালিস্ট কনীনিকার কর্মক্ষেত্র মিডিয়ার কর্পোরেট জগতের ঘৃণ্য রাজনীতিকে উন্মুক্ত করে, আবার কখনো তা তার ব্যক্তিগত জীবনে প্রেমিক অদম্যর সাথে মানসিক ব্যক্তিগত ঘাত প্রতিঘাতকে তুলে ধরে। আপাতদৃষ্টিতে সব ছিন্ন ছিন্ন ঘটনা, কিন্তু সূক্ষ্মভাবে কোথাও একসুতোয় বাঁধা। তবে বইয়ের যে দুটি চরিত্র ব্যক্তিগতভাবে আমার সবচেয়ে মনোগ্রাহী লেগেছে সেদুটি হল, সপ্তক এবং ভূমিকা। প্রথমজন, যার চিকিৎসক হয়ে ওঠার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ জনসাধারণের রোষের শিকারে সর্বার্থে শয্যাশায়ী; অপরজন, অদম্যর তথ্যপ্রযুক্তি কর্মক্ষেত্রের সহকর্মিণী। আঘাতপ্রাপ্ত সপ্তকের মধ্যে জেগে উঠেছে ভবিষ্যৎকে দেখতে পাওয়ার এক অতিলৌকিক ক্ষমতা (Clairvoyance), আর ভূমিকা? থাক, তার রহস্য বই পড়তে পড়তে না জানলে মজাটাই নষ্ট। মূলতঃ এই দুটি চরিত্রের কারণেই চিরাচরিত সামাজিক উপন্যাসের ধারা বদলে গল্পে থ্রিল এলিমেন্ট ঢুকে লেখাটি এক ছকভাঙা অন্য পর্যায়ে উত্থিত হয়েছে। আরেকটা ব্যাপার আমার সবচেয়ে যেটা ভালো লেগেছে তা হল, সকল চরিত্রই ধূসর, যা অত্যন্ত বাস্তবধর্মী। অ্যাবসলিউট গুড বা অ্যাবসলিউট ব্যাড বলে কিছু হয় না। আমরা প্রত্যেকটি মানুষ ষড়রিপুর মায়ায় আবদ্ধ। আমরা ভুল করি, আবার তা থেকে শিক্ষা নিয়ে গড়ে উঠি। আর এই ওঠাপড়ার মাঝেই নিজস্ব মরাল স্ট্যান্ডার্ড সেট করি যা কিনা পুরোটাই আপেক্ষিক। এই সূক্ষ্ম দিকটাকেই ‘পরবর্তী সংবাদ একটু পরেই’ মুন্সিয়ানার সাথে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। এ বইতে তথাকথিত কোনো হিরো বা ভিলেন নেই। আছে কিছু মানুষ যারা ঘরে বাইরের লড়াইয়ে নিজেদের ব্যক্তিগত আশা আকাঙ্খা, ক্ষোভ, ভালোবাসা, প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তির মানসিক দ্বন্দের সাথে যুঝে গেছে, হতাশ হয়েছে, আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। হ্যাঁ, দৈনন্দিন জীবনে আমার আপনার মতই। মানব চরিত্রের ধূসরতার এই নিরপেক্ষ জটিল মূল্যায়নই এ বইয়ের অন্যতম সম্পদ।

এবারে আসি লেখনীর স্টাইল এলিমেন্টে। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, বাংলাভাষায় লোকে লেখে। কিভাবে লিখছে এই ব্যাপারটার গুরুত্ব কখনোই আমাদের আলোচনাতে সেভাবে উঠে আসে না। অথচ বিশ্বসাহিত্যের ক্ষেত্রে লেখার পদ্ধতি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং তা বিভিন্ন ধারায় বিভক্ত। পরবর্তী সংবাদ একটু পরেই বইটির ক্ষেত্রে লেখক অর্ঘ্য দত্ত সমসাময়িককালের উপন্যাস নির্মাণের সেই চিরাচরিত গণ্ডীর বাইরে গিয়ে খেলেছেন। চমৎকার বাক্যবিন্যাস, অসাধারণ মননের প্রতিফলন এবং সর্বোপরি টানটান গতিময় লেখা। একনিঃশ্বাসে শেষ হবেই। কিছুক্ষেত্রে লেখা ব্যাখ্যাধর্মী, সরল, সাবলীল আর অনেকক্ষেত্রে প্রতিটি বাক্যে জার্ক রয়েছে (প্রতিটি লাইন পাঠককে ধাক্কা দেয়)। ঘাটের বর্ণনার ক্ষেত্রে বর্ণনা কিছুক্ষেত্রে একটু একঘেয়ে লেগেছে আবার কিছুক্ষেত্রে মূল গল্পের টোনের সাথে দারুণ মেলানো হয়েছে। ছোট ছোট বাক্যের জার্ক বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই ইমপ্যাক্ট তৈরি করে আবার মাঝে মাঝে চোখকে পীড়া দিয়ে ছন্দ কেটে দেয়। ব্যাস, এটুকুই! এছাড়া এ বইতে আর কোনও নেগেটিভ পয়েন্ট দেখিনি আমি।

পরিশেষে বলি, সামান্য একদুটো টাইপো ছাড়া বইটির প্রচ্ছদ, ভেতরের অঙ্গসজ্জা, পরিচ্ছেদ নির্মাণ, পাতার গুণমান একেবারে প্রথমশ্রেণীর এবং ব্যতিক্রমী। অত্যন্ত যত্ন নিয়ে লেখক বইটি লিখেছেন। পাবলিশার, প্রচ্ছদশিল্পী প্রমূখ যারা এই সমগ্র প্রোজেক্টটির সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত, তাঁরা উপন্যাসের বিষয়বস্তুকে মাথায় রেখে যথাযথ পরিশ্রম এবং সুচিন্তিত প্রতিফলনের মাধ্যমে লেখকের ট্যালেন্টের যোগ্য আনুষাঙ্গিক মর্যাদা দিয়েছেন। বাংলা ভাষায় এতোটা সর্বাঙ্গীনসুন্দর কাজ বহুদিন চোখে পড়েনি।

সংগ্রহে রাখার মতো বই কিনা?

‘অন্ধকারে বসে থাকা জন্তুটার কচমচ করে হাড়মাংস চিবানোর বীভৎস আওয়াজ পাওয়া যেতে লাগলো।‘
অথবা, ‘নরকঙ্কালটির গনগনে ভাঁটার মতো চোখের দিকে তাকিয়ে লালপট্টবস্ত্রপরিহিত তান্ত্রিক হুঙ্কার দিয়ে উঠলো’ ইত্যাদি এই ধরণের লেখা দুর্ভাগ্যবশত এ বইতে পাওয়া যাবে না।

বরং কি পাওয়া যেতে পারে তার একটা উদাহরণ তুলে দি,

দুটো জাতি। দুজনেই এই মাটিতে এল ব্যবসার জন্য। দুজনেই সমৃদ্ধ হল বাণিজ্যে, এই মাটি থেকে। একজন মিশে গেল রোজকার জীবনে, হয়ে গেল এই মাটির অংশ। আরেকজন ব্যবসায়ী থেকে শাসক হয়ে মাটিকেই ভাগ করে দিয়ে চলে গেল।

ইংরেজ এবং আর্মেনিয়।

একজন কেবল ভ্রান্তির উপক্রমণিকা, আরেকজন অক্ষিতারকা।
ভূমিকা এবং কনীনিকা।

…আমি তো সংগ্রহে রেখেছি, বাকিটা আপনার অভিরুচি।
————————–
মূল পোস্টের লিঙ্ক:
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=4375558222470537&id=100000492072306

Reviews

There are no reviews yet.

Be the first to review “পরবর্তী সংবাদ একটু পরেই”

Your email address will not be published. Required fields are marked *